মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বার ২০২৩, ১১ আশ্বিন ১৪৩০

বিশ্বনাথ রায়

Aug. 6, 2023, 9:40 p.m.

শ্রাবণ ধারায় শান্ত সমাহিত রবী
শ্রাবণ ধারায় শান্ত সমাহিত রবী
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা - ছবি:

এখন শ্রাবণ মাস। প্রবল বর্ষায় মুখরিত প্রকৃতি। বাঙার্লি জাতির আপনার জন প্রাণের মানুষ রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যে বর্ষার জয়গান গেয়েছেন অবিরত। বর্ষার অজ¯্র জলধারায় পুষ্ট তার বহুবিচিত্র রচনা সম্ভার। তার গান কবিতায় গল্পে উপন্যাসে কিংবা প্রবন্ধে সর্বক্ষেত্রে বর্ষার রূপায়ন। তাই বর্ষার বরপুত্র রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির পরতে পরতে সৃজনী বর্ষার ছোঁয়া। সে কারণেই বোধ করি বিশ্বকবির অনন্তলোকে জয়যাত্রা ২২ শে শ্রাবণে।

মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। কৈশোরকালীন সময়ে মৃত্যু শ্যামের সমান। ব্রজবুলি ভাষায় মরণ কবিতায় কবি লিখেছেন মরণরে “তুঁহু মম শ্যামসমান”। যৌবনে তিনি মানবের মাঝে বাঁচতে চাইছেন। লিখেছেন “মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে”, আবার তিনি দেশবন্ধুর মৃত্যুতে লিখেছেন “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে”। একইভাবে অতুল প্রসাদ সেনের মৃত্যুতে কবি বলছেন “দীর্ঘ আয়ু দীর্ঘ অভিশাপ”।

রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যে যে মৃত্যুদর্শন এঁকেছেন তা নান্দনিক জীবন দর্শণে পরিগণিত হয়েছেন। উপনিষদের সার পবিত্র গীতাগ্রন্থের সাংখ্যযোগে আত্মার অবিনাশী তত্ত্বকে ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ বরণ করেছিলেণ সমত্ববুদ্ধি (ওহঃবষষরমবহঃ ডরষষ) দিয়ে। স্ত্রী, পুত্র, কণ্যা ও জামাতাদের প্রয়াণে নিদারুন মৃত্যু মিছিল সহ্য করেও লিখতে পেরেছেনÑ তোমারই ইচ্ছা কর যে পূর্ণ আমার জীবন মাঝে। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যু বরণ করেছেন কিন্তু সৃষ্টিসম্ভার রয়েছে সজীব-সতেজ। তার অসামান্য সৃজনশীলতা, ভাষার প্রকাশভঙ্গী, অনন্তজীবন বোধ দিয়ে সমগ্র বিশ্বে নিজেকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছিলেণ। তার লেখনি বিভিন্ন দেশে পাঠ্যসূচিতে সংযোজিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ বহু বিষেয় পন্ডিত । ৮ বছর বয়স থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি অবিরাম লিখেছেন তিনি। তার আঙ্গুলিশীর্ষে সরস্বতী বিদ্যুৎ বাহিনী। বাঙালির বাঙালিসত্ত্বা ও বোধের অপার আধার রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী জাতির সকল আশা নিরাশা, আকাঙ্খা, ভালমন্দ, দুঃখ-বেদনার জীবনানুভুতি তার লেখার উপজীব্য। আমাদের বেদনা-দহনে সুখে ও সংগ্রামে সর্বত্রই তিনি। এটা সর্বৈব সত্য যে, রবীন্দ্রনাথ সর্বযুগের সার্বজনীন কবি। প্রাচ্য ও পাশ্চত্যকে সমানভাবে হৃদয়ে সমানভাবে ধারণ করেছে তিনি। যাকে এক কথায় বলা যেতে পারে, অ হবি রহংরমযঃ। উপনিষদসূত রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বের সাথে উপলিব্ধ করেছেন, ভারবর্ষের সত্যিকারের পরিচয় অখন্ড মানব চৈতন্যে, মানুষে মানুষে ঐক্যতান। তাই তিনি হতে পেরেছিলেন ঈড়ংসড়ঢ়ড়ষরঃরড়হ অর্থাৎ বিশ্বপ্রেমিক।

রবীন্দ্রনাথ শুধু সমাজ সচেতন কবিই নন, সচেতন মানুষও বটে। তাই জীবন ব্যাপী সক্রিয় থেকেছেন সমাজ সংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, কৃষি ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে। সফল জমিদার হিসেবে জনকল্যানে ব্রতী থেকেছেন। পৃথিবীর ৫টি মহাদেশে ত্রিশটিরও বেশি দেশ  ভ্রমন করে হৃদয় রাজ্য করেছেন ঋদ্ধ। প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম অর্থাৎ জ্ঞানই ব্রহ্ম এই সত্যকে সর্ব গুরুত্ব দিয়েছেন। রচনা করেছেন ৫২টি কবিতার বই, ৯৫টি ছোট গল্পের বই, নাটকের ৩৮ বই, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ। এছাড়াও দুই হাজারেরও অধিক গান রচনা করেছেন। লিখেছেন অসংখ্য চিঠিপত্র। যা ১৯ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। শেষের দিকে চিত্রকলাতেও অসম্ভব পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমাদের চিন্তার ভূগোল, রস আস্বাদন কিংবা ভাবের প্রকাশ সম্ভবপর নয়। সব যুগের সব ভাষার বরনীয় কবির মৃত্যু যখন সুনিশ্চত তখন মহাত্মা গান্ধীর প্রার্থণা-  প্রিয় গুরুদেব, আপনাকে এখনও কিছুকাল বাঁচিতে হইবে, বিশ্ব মানবের জন্য আপনার প্রয়োজন। কিন্তু মৃত্যু যে অমোঘ। জাতস্য হি ধ্রব মৃত্যু। জাতের মৃত্যু সুনিশ্চত। বিশ্বজনের আদৃত কবি রবীন্দ্রনাথ এর ব্যতীক্রম নয়। কবিগুরু তার রচনায় যে পরমার্থের সন্ধান করেছিলেন সেই পরমার্থেই লীন হলেন ঘণবরিষায়। শ্রাবণ ধারায় শান্ত সমাহিত রবী অমৃতলোকে মৃত্যুকে করলেন জয়।